জরিপের ভুলে হারাচ্ছে পাহাড়, সংকটে চট্টগ্রামের পরিবেশ
চট্টগ্রামের হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড ও নগরের বিভিন্ন এলাকায় এক সময় সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়-টিলা আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। সরকারি জরিপে নানা ভুলের কারণে প্রায় ১ হাজার ৪০০ একর পাহাড়ি জমি ‘নাল’, ‘শণখোলা’, ‘খিলা’, ‘বাড়ি’ ইত্যাদি ভিন্ন শ্রেণিতে নথিভুক্ত হয়েছে। ফলে এসব জমি আর পাহাড়ি জমি হিসেবে আইনি সুরক্ষা পাচ্ছে না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিমালিক ও প্রভাবশালী মহল পাহাড় কেটে গড়ে তুলছেন বসতি, প্লট ও বহুতল ভবন।
পাহাড় কেটে দখলদারি
বিশেষজ্ঞদের মতে, জরিপের এই ত্রুটি পাহাড় রক্ষার বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভিন্ন শ্রেণিতে নথিভুক্ত হওয়ায় ভূমি অফিসে এগুলো আর পাহাড়ি খাসজমি হিসেবে চিহ্নিত থাকছে না। এতে দখলদাররা সহজেই মালিকানা দাবি করতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জমির দলিল দেখিয়ে প্রভাবশালী মহল আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পাহাড় কেটে দখল করছে। বসতি গড়ে তুলছে এলোমেলোভাবে, কোথাও হচ্ছে বাণিজ্যিক প্লট বিক্রি, আবার কোথাও উঠছে বহুতল ভবন।
পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব
পাহাড় কেটে এভাবে গড়ে ওঠা অবকাঠামো কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই ধ্বংস করছে না, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। পাহাড় কেটে গেলে মাটির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, সৃষ্টি হয় ভাঙন ও ভূমিধসের ঝুঁকি। একইসঙ্গে নষ্ট হচ্ছে এলাকার প্রাকৃতিক খাল-নালা, শুকিয়ে যাচ্ছে জলাধার। জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল বিলীন হয়ে যাওয়ায় পাখি ও প্রাণীকুল হারাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি হয়। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা আরও প্রকট হচ্ছে।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতা
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ভূমি জরিপে ভুল থাকলেও আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবই দখলদারদের বাড়াবাড়িকে উৎসাহিত করছে। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়ে এসব কাজ নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। যদিও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানোর দাবি তুলছেন পরিবেশকর্মীরা, বাস্তবে তেমন পদক্ষেপ খুব একটা চোখে পড়ে না।
টেকসই সমাধানের দাবি
বিশেষজ্ঞদের মতে, জরিপ সংশোধন করে পাহাড়ি জমির সঠিক শ্রেণি নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে পাহাড় কাটা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ, দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা এবং বিকল্প আবাসন পরিকল্পনা নেওয়া ছাড়া এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানো সম্ভব নয়।
চট্টগ্রামের মানুষ একসময় গর্ব করতেন পাহাড়-টিলায় ঘেরা সবুজ সৌন্দর্য নিয়ে। অথচ আজ সেই পাহাড়ই জরিপের ভুল আর মানবসৃষ্ট দখলদারির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বড় হুমকির মুখে পড়ছে এখানকার জলবায়ু ও পরিবেশ।