“আমি যদি না থাকি, তাহলে কারও সমস্যা থাকবে না” — এ ধরনের অভিমানী ভাবনা অনেক কিশোর-কিশোরীর ডায়েরি বা মনে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এই লুকানো যন্ত্রণাই একদিন জীবনের শেষ করার ভাবনায় রূপ নেয় — একটি সম্ভাবনাময় জীবন হারিয়ে যায়। কেন তারা এমন পথ বেছে নেয়?
আজ ১০ সেপ্টেম্বর — প্রতিবছর এই দিনটি বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এদিন আমাদের ভাবতে হবে, সচেতন হতে হবে: কেন অল্প বয়সে একজন মানুষ, যার সামনে পুরো জীবন ও ভবিষ্যৎ রয়েছে, তারাও কখনো-কখনো আত্মহত্যার কথা ভাবতে যায়?
কেন আত্মহননের চিন্তা আসে?
ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, বাইপোলার ডিসঅর্ডারসহ বিভিন্ন মানসিক রোগ আত্মহননের প্রবণতার বড় কারণ। পাশাপাশি পরিবারের ভাঙন — বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, পারিবারিক সহিংসতা বা অনিরাপদ ঘর—ও তরুণদের মনে গভীর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
শিক্ষাজনিত চাপ—পরীক্ষায় ব্যর্থতা, অতিরিক্ত প্রত্যাশা, ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা—অনেককেই হতাশায় ঠেলে দেয়। সামাজিক চাপ, বুলিং, অপমান, উপেক্ষা, একাকিত্ব, মাদকাসক্তি ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্পষ্টতা—এসবও আত্মহননের চিন্তা বাড়ায়।
সবচেয়ে বিপজ্জনকটিই হলো: আমরা এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলি না। চুপচাপ থাকা, লজ্জা বা কুসংস্কার আত্মহননের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ধারণা বদলাতে হবে
বিশ্বজুড়ে প্রত্যেক বছর বহু জীবন আত্মহত্যায়/end হয়, অনেকেই তরুণ। তবু সমাজে আত্মহত্যা নিয়ে নীরবতা, ভুল বোঝাবুঝি ও অপরাধবোধ কাজ করে। এই নীরবতা ভাঙতে না পারলে সংকট মোকাবিলা করা কঠিন। সচেতনতা এবং খোলামেলা আলোচনা জরুরি।
পরিবার ও অভিভাবকের ভূমিকা
পরিবার ও অভিভাবকেরাই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা-জাল গড়তে পারে। সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন অন্তত একটু সময় কাটান — শুধুমাত্র পড়াশোনা নিয়ে নয়, তাদের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থাও জানতে চাওয়া জরুরি।
যদি আচরণে পরিবর্তন দেখেন — চুপ করে যাওয়া, বন্ধুবান্ধব এড়িয়ে চলা, ঘুম বা খাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন — এগুলোকে গুরুত্ব দিন। প্রয়োজন হলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব
শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানকে বুলিং বা হেনস্তা প্রতিরোধে কঠোর নীতি নিতে হবে। হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীর প্রতি সহানুভূতিশীল হন, অভিভাবকের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ান এবং বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সার্ভিস চালু করুন।
সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের পদক্ষেপ
গণমাধ্যমকে আত্মহত্যার খবর প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হতে হবে — সংবেদনশীল ভাষা ব্যবহার ও বর্ণনামূলক বিশদ বর্জন করা জরুরি। শিশু-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়ানো ও সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
কিশোর–তরুণদের প্রতি বার্তা
কথা বলুন — কিছু লুকাবেন না। পরিবার, বন্ধু বা শিক্ষকের কাছে যাওয়া সংকটের প্রতিকার হতে পারে। ব্যর্থতা মানেই জীবন শেষ নয়; অধিকাংশ সংকট সাময়িক — এ কথা মনে রাখুন।
মানসিক কষ্টে সাহায্য নেওয়া দুর্বলতার চিহ্ন নয়, বরং সাহসের পরিচয়। যদি কোনো বন্ধু বা আত্মীয় আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেয়, অবহেলা করবেন না — তাদের গুরুত্ব দিন, কথা শুনুন এবং পেশাদার সাহায্যের দিকে নিয়ে যান।
সমাপ্তি
আত্মহত্যাকে লজ্জা, অপরাধ বা দুর্বলতা হিসেবে দেখা উচিত নয় — এটি প্রতিরোধযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা। পরিবার, শিক্ষক, সমাজ ও নীতিনির্ধারক মিলে দায়শীল ভূমিকা নিলে অসংখ্য তরুণ জীবন বাঁচানো সম্ভব। সচেতনতা ও খোলামেলা কথোপকথনের মাধ্যমেই আমরা এই সংকট মোকাবিলা করতে পারি।