সকাল থেকেই শরতের আকাশে যেন অভিমান জমে আছে। চারপাশ ঘন মেঘে ঢাকা, ভ্যাপসা গরমে ভারী পরিবেশ। কীর্তনখোলা নদী তখন ভরা জোয়ারে উত্তাল, বুক চিরে ছোট ছোট ঢেউ গিয়ে ভাঙছে বন্দরের পাড়ে। বরিশাল নদীবন্দরে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে একতলা ছোট লঞ্চ। প্রতিটি লঞ্চেই সকালবেলার ব্যস্ততার শব্দ—কোথাও ভেঁপুর সুর, কোথাও মাইকে ভেসে আসছে পরিচিত ডাক:
“যাঁরা ভোলা, মজুচৌধুরী যাবেন, তাঁরা তাড়াতাড়ি আসুন, চলুন চলুন…”
এই ডাক শুনে দৌড়ে আসছেন যাত্রীরা। কেউ ওপরে পাতা বেঞ্চের প্রথম শ্রেণিতে, কেউ নিচতলার তৃতীয় শ্রেণির আসনে, কেউ আবার সানকিন ডেকের বেঞ্চে গা ঠেকাচ্ছেন।
রোববার সকাল সাড়ে সাতটায় যাত্রীভর্তি লঞ্চগুলো একে একে ছাড়তে শুরু করল। এমএল সোহেলি তখন ভোলার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। নদীর বুক চিরে এগোতেই কীর্তনখোলার বাতাস কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। আমরাও সেই যাত্রীদের সঙ্গী, গন্তব্য দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা—ভোলা।
একসময় দক্ষিণের মানুষের প্রধান ভরসা ছিল এসব ছোট লঞ্চ। নব্বই দশক পর্যন্ত কাঠের তৈরি কিংবা স্টিল বডির সানকিন ডেক লঞ্চ ছুটে বেড়াত নদীপথে। ঘাটগুলো জমজমাট থাকত, বাজত ভেঁপু, শোনা যেত ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক—
“অ্যাই রুটি-কেক!”,
“আমড়া নিন, ঝালমশলায় মাখানো আমড়া!”,
“বাদাম লাগবে… বাদাম!”
কিন্তু সময় বদলেছে। সেতু, ফেরিঘাট আর সড়ক উন্নয়নে কমেছে যাত্রী, পরিত্যক্ত হয়েছে অনেক লঞ্চ। অনেক ঘাট এখন সুনসান। তবুও ভোলায় এই ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে। এখানকার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা—সব কিছুর জন্য লঞ্চই ভরসা।
বরিশাল থেকে আধা ঘণ্টা পরপর ভেদুরিয়ার উদ্দেশে লঞ্চ ছাড়ে, আবার ভেদুরিয়া থেকেও আসে লঞ্চ। সোয়া দুই ঘণ্টার পথ, বেশির ভাগই সানকিন ডেক লঞ্চ।
কীর্তনখোলা পেরিয়ে সোহেলি ঢুকে যায় সরু বুখাইনগর নদে। দুই পাড়ের দৃশ্য যেন হাতছানি দেয়—ধানখেত, খেলায় মত্ত শিশু, নদীর বুকজুড়ে ছোট ছোট ঢেউ। লাহারহাট ঘাটে পৌঁছাতেই ভিড় করা যাত্রীরা ঝাঁপিয়ে ওঠে লঞ্চে। এরপর নতুন শ্রীপুর, পুরোনো শ্রীপুর, ইলিশা—এভাবেই ঘাটে ঘাটে থামতে থাকে।
কালাবদরের মোহনায় পৌঁছেই নদীর চেহারা বদলে যায়। হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে ঢেউ, ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পানি এসে আছড়ে পড়ে লঞ্চে। নিচতলায় বসা অনেকেই ভিজে যান। কেউ ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়েন, আবার অভ্যস্ত যাত্রীরা নির্বিকার থাকেন।
লঞ্চে নানা রঙের গল্পও বোনা হয়। কেউ মহিষের দুধ নিয়ে ভোলায় যান বিক্রির জন্য, কেউ ওষুধ বিক্রি করেন সাউন্ডবক্সে গলা চড়িয়ে। ওপরে বসা যাত্রীরা রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মত্ত, আর নিচতলায় যাত্রীরা ব্যস্ত জীবিকা ও টিকে থাকার কথায়।
এ যেন দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষুদ্র এক সমাজ—একই যাত্রায় মিশে যায় আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-ভয়, ব্যবসা-রাজনীতি, জীবন-জীবিকার টানাপোড়েন। কীর্তনখোলা থেকে কালাবদরের ঢেউ পেরিয়ে ভেদুরিয়ার ঘাটে লঞ্চ নোঙর ফেলতেই মনে হয়, শুধু লঞ্চ নয়—সময়ও যেন থেমে দাঁড়াল।