বিরল রোগ: শিশুর অচল হওয়ার চোখের সামনে, মা–বাবার অসহায়তা
মাথা ভর্তি চুল, মুখে কথা, গান—সব কিছু ঠিকঠাক করছে চার বছর বয়সী শিশু অলিভিয়া সঞ্চারী নবনী। তবে সে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারে না, বসলেও মাথা ঢলে পড়ে। তার পেশিতে প্রয়োজনীয় শক্তি নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের নাম স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ)।
অলিভিয়ার বাবা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, জন্মের ২৫–২৬ দিন পর লক্ষ্য করা যায় মেয়ের পা কম নড়াচড়া করছে। করোনার সময় ভারতে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করে নভেম্বরে জানা যায় মেয়ের এসএমএ। এই রোগ বংশগত, মা-বাবা উভয়ই বাহক হলে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার ২৫ শতাংশ ঝুঁকি থাকে।
এসএমএ–তে পেশির শক্তি ক্রমশ কমে যায়, দাঁড়ানো, হাঁটা, সিঁড়ি ওঠা কঠিন হয়। খাবার চিবানো ও গিলতেও সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত ১০,০০০ শিশুর মধ্যে একজনের এই রোগ হয়।
বিরল রোগের পরিধি
বিরল রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে প্রতি দুই হাজার মানুষের মধ্যে এক বা তার কম মানুষকে এই রোগ হয়। বিশ্বে প্রায় ৭,০০০ ধরনের বিরল রোগ আছে, যার প্রায় ৩০ কোটি মানুষ ভুগছে। ৭০ শতাংশই শিশু বয়সে শুরু হয়। এসব রোগ জটিল, একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে, দ্রুত অবনতির দিকে যায় এবং অকালমৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশে জানা বিরল রোগের মধ্যে রয়েছে: এসএমএ, ডুচেনি মাসকুলার ডিস্ট্রোফি (ডিএমডি), হিমোফিলিয়া, মোয়ামোয়া, সিফা সিনড্রোম, রেটস সিনড্রোম, প্রজেরিয়া, এক্সপি (জেরোডার্মা পিগমেনটোসাম), ট্রি ম্যান সিনড্রোম। দেশে এসএমএ রোগীর সংখ্যা ২০০–৩০০, ডিএমডি রোগী প্রায় দুই শতক।
চিকিৎসা ও চ্যালেঞ্জ
বিরল রোগের সঠিক চিকিৎসা অনেকের জন্য নেই। এসএমএ–এর ক্ষেত্রে জিনথেরাপি, ইনজেকশন বা সিরাপ ব্যবহার হয়। জিনথেরাপির দাম প্রায় ২২ কোটি টাকা, ইনজেকশন এক কোটি, সিরাপ প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা। অনেক রোগীর কাছে ওষুধের খরচ বহনযোগ্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৯৫ শতাংশ বিরল রোগের কার্যকর চিকিৎসা এখনও নেই।
অভিভাবকের অসহায়তা
বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুর মা–বাবা প্রায়শই অকেজো। তাদের দৈনন্দিন জীবন পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়। সময়, সামাজিক অনুষ্ঠান, কাজ—সব কিছু ছাপিয়ে যায় শিশুর যত্নে। অনেক অভিভাবক মানসিক ও আর্থিক চাপের মুখোমুখি হন।
প্রয়োজন ও উদ্যোগ
-
রোগ শনাক্তে উপযুক্ত ল্যাবরেটরি স্থাপন।
-
দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।
-
রোগী-কেন্দ্রিক সহায়তা ও সামাজিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।
-
সুলভ ওষুধের প্রবেশাধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
দেশে কিছু সংগঠন কাজ করছে, যেমন কিওর এসএমএ বাংলাদেশ, ডিএমডি কেয়ার ফাউন্ডেশন। তারা রোগনির্ণয়, চিকিৎসা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল নিয়মিত ক্লিনিক ও সেমিনারের মাধ্যমে বিরল রোগের শিশুদের সহায়তা করছে। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসএমএ চিকিৎসা ও সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
সহজভাবে বলা যায়, বিরল রোগ নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা, সচেতনতা, সুলভ চিকিৎসা ও রোগী-কেন্দ্রিক সহায়তা ছাড়া মা–বাবার অসহায়তা অব্যাহত থাকবে।
collected